‘আফ্রিকা’
– রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
- রবীন্দ্রনাথ এমন একজন কবি ব্যক্তিত্ব – যাকে বিশেষ অভিধায় অভিহিত করা যায় না । তিনি একাধারে কবি, ছোট গল্পকার, প্রাবন্ধিক, নাট্যকার, ঔপন্যাসিক, আবার অসংখ্য গানের স্রষ্টা । রবীন্দ্রনাথ এমন একজন গল্পকার যার গল্পের মধ্যে সমাজ বাস্তবতা উঠে এসেছে । তিনিই প্রথম ঔপন্যাসিক, যার লেখার মধ্যে আঁতের কথা উঠে এসেছে । তিনি অসংখ্য গানের স্রষ্টা, আবার একদিকে জমিদার হিসেবে মানুষের দূর থেকে দেখছেন । আবার এই রবীন্দ্রনাথ জালিয়ানওয়ালাবাগের হত্যাকাণ্ডের (১৯১৯ ) প্রতিবাদে ইংরেজ সরকারের দেওয়া ‘নাইট’ঔপাটি ত্যাগ করতে পারেন ।
এতো কর্মকান্ডের মধ্যে তিনি বলছেন – তার একটাই পরিচয় “আমি কবি মাত্র” ।
- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘পত্রপুট’ কাব্যের অসামান্য কবিতা হল ‘আফ্রিকা’ ।
- ১৯১৬ সালের ‘বলাকা’ কাব্যগ্রন্থের পর রবীন্দ্রনাথের ‘পত্রপুট’ এমন একটা কাব্যগ্রন্থ যেখানে আন্তর্জাতিক কবি রবীন্দ্রনাথের জীবনদর্শন, জীবনবোধ, তাঁর যুদ্ধবিরোধী মনোভাব, সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী মনোভাব ফুটে উঠেছে ।
- ১৩৪০ বঙ্গাব্দে চৈত্র, ইংরেজি মার্চ-এপ্রিল ১৯৩৩ সাল থেকে পৌষ ১৩৪৪ বঙ্গাব্দে অর্থাৎ ডিসেম্বর ১৯৩৭ পর্যন্ত এই সময় ‘পত্রপুটের’ কবিতাগুলো তিনি লিখেছেন ।
- অধিকাংশ কবিতা ১৩৪২ সালে শান্তিনিকেতনে লেখা হচ্ছে । ‘আফ্রিকা’ কবিতাটি প্রথম প্রকাশিত হয় ‘প্রবাসী’ পত্রিকায় চৈত্র ১৩৪৩ সংখ্যায় ।
- ১৩৪৩ বঙ্গাব্দে ২৫ শে বৈশাখ কবির জন্মদিনে ‘পত্রপুট’ কাব্যগ্রন্থ রচিত হয় ।
- প্রথম সংস্করণে কবিতার সংখ্যা ছিল ১৬ টি ।
- দ্বিতীয় সংস্করণে আরো দুটি কবিতা যুক্ত হয় । তাঁর একটি হল ‘আফ্রিকা’ ।
- প্রথম যেমন বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়, রবীন্দ্রনাথের ক্ষেত্রে ও হয়েছিল । ‘পত্রপুট’ কাব্যের দুটি বিজ্ঞাপন দেওয়া হয় –
- প্রথম বিজ্ঞাপন দেওয়া হয় ‘প্রবাসী’ পত্রিকায় – ১৯৩৬ সালে । যেখানে বলা হয় – ” এটি উপহার দেবার জন্য চমৎকার একটি বই । ” এবং চমৎকার কাগজে ছাপা ও সুদৃশ্য বাঁধাই । তখন কাব্যটির দাম ছিল মাত্র ১ টাকা ।
- আনন্দবাজার পত্রিকায়-১৬ আগস্ট দ্বিতীয় বিজ্ঞাপন দেওয়া হয় । বইটি বিপর্ননের জন্য ।
- কাব্যটি সম্পর্কে সমকালীন প্রতিক্রিয়া :
- কবি অমিয় চক্রবর্তী বলেন – “মনে হল যেন 16 টি ode একত্রিত করা হয়েছে বিশ্বসাহিত্য থেকে বাছাই করে করে” “
- নীহার রঞ্জন রায় বলেছেন – “বলাকার পর সকল দিক হইতে এতো বিশিষ্ট, এতো মহৎকাব্য রবীন্দ্রনাথ আর রচনা করেন নাই” । (রবীন্দ্রসাহিত্যের ভূমিকা গ্রন্থে)
- উপেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য বলেন – “পত্রপুটের কবিতাগুলো ভাবের গভীরতায় ও প্রকাশের গাম্ভীর্যে অসামান্য বৈশিষ্ট সম্পন্ন” ।
- আফ্রিকা কবিতাটি ‘পত্রপুট’ কাব্যের ১৬ সংখ্যক কবিতা । কবিতাটির রচনাকাল মাঘ, ১৩৪৩ বঙ্গাব্দ এবং প্রকাশকাল হল চৈত্র ১৩৪৪ বঙ্গাব্দ ।
‘আফ্রিকা’ কবিতাটি লেখার কারণ:
ইউরোপীয় সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলি বহুকাল ধরেই আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে উপনিবেশ স্থাপন করে দমন-পীড়ন চালাচ্ছিল । ১৯৩৫ খিষ্টাব্দে ইটালির মুসোলিনি আফ্রিকায় আবিসিনিয়া (বর্তমান ইথিওপিয়া) আক্রমণ করে |সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে রবীন্দ্রনাথের কলম বারবার লর্জে উঠেছে । ক্যাসিস্ট মুসোলিনির আবিসিনিয়া দখলের ঘটনা কবির মনে ক্ষোভের সঞ্চার করে ।
১৯৩৬ সালে ৩১ শে ডিসেম্বর লেখা একটি পত্রে নির্যাতিত, নিষ্পেষিত আফ্রিকাবাসীদের করুন চিত্র তুলে ধরে একটি চিঠিতে অমিয় চক্রবর্তী, রবীদ্রনাথকে লেখেন –
“আমার কেবলি মনে হচ্ছিল আফ্রিকার এই Tribe Etera নিয়ে আপনি যদি একটি কবিতা লেখেন । আফ্রিকা সম্পর্কে আপনার কোন কবিতা নেই । এই রকম কবিতা পেলে কিরকম আনন্দ হবে বলতে পারি না ।“
২৭ শে মাঘ, ১৩৪৩ বঙ্গাব্দে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন –
২৭ শে মাঘ কল্যাণীয়াষু, আফ্রিকা নিয়ে তুমি কবিতা লিখতে অনুরোধ করেছিলে, আমি সেই অনুরোধ রেখেছি। আমি ‘আফ্রিকা ‘ কবিতা লিখেছি।
কবিতার মূলভাব–
“আফ্রিকা” কবিতার স্তবক সংখ্যা 8 টি, মোট লাইন সংখ্যা- ৫0 রবীন্দ্রনাথ দেশকাল সম্বন্ধে, জাতীয়তাবাদ সম্বন্ধে, আন্তর্জাতিকতাবাদ সম্পর্কে যথেষ্ট সচেতন ছিলেন, ছিলেন সজ্জাল ।
কবিতার মূলভাব কে ৫ টি একমুখী রেখাতে নিরীক্ষণ করতে পারি ।
- প্রথমত: সমাজ কবিতা জুড়ে আছে উপনিবেশবাদের বিরুদ্ধে কবির প্রবল ঘৃণা। রবীন্দ্রনাথ ছিলেন যুদ্ধবিরোধী কবি । ‘প্রান্তিক’ কাব্যে, নবজাতক কাব্যে, অসামান্য ছোট গল্প মেঘ ও রৌদ্র, ধ্বংস গল্পে, একাধিক প্রবন্ধে- সভ্যতার সংকটে – তিনি একাধিক বার বলছেন আমরা বিপর্যস্ত হচ্ছি পাশ্চাত্যের দুনিয়ার দ্বারা । আমরা প্রতিমুহূর্তে সংক্রামিত হচ্ছি । রবীন্দ্রনাথ পাশ্চাত্যের এই আগ্রাসা-মনোভাব, সাম্রাজ্যবাসী মনোভাব, ক্যাসিস্ট মনোভাবের বিরুদ্ধে লিখেছেন, বলেছেন, বক্তৃতা দিয়েছেন । রবীন্দ্রনাথ এইভাবে বারবার প্রতিবাদ করেন বলে আমরা সাহস পাই । রমারোঁল্যা বলেন——“যদি ভারতবর্ষের সংস্কৃতিকে জানতে চাও তাহলে রবীন্দ্রনাথ এবং ভারতবর্ষের আধ্যাত্মিকতাকে জানতে চাইলে বিবেকানন্দকে জানতে হবে ।”
- দ্বিতীয়ত: লাঞ্চিত, নিপীড়িত আফ্রিকাবাসীদের প্রতি কবির প্রগাঢ় সহানুভূতি প্রকাশিত হয়েছে । পাশ্চাত্য দুনিয়ার পার্শবিক আচরণের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ করেছেন ।
- তৃতীয়ত: ‘আফ্রিকা’ সৃষ্টির ভৌগোলিকে বর্ণনা দিয়েছেন । আফ্রিকা কিভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছে প্রাচী ধরিত্রীর বুক থেকে মায়ের কোল থেকে সন্তানকে কেড়ে নিলে যেমন সন্তানের অস্তিত্ব বিপন্ন হয়-ঠিক তেমনি আফ্রিকার অস্তিত্ব বিপন্ন হয়েছিল প্রাচীনকালে ।
- চতুর্থত: ইউরোপীয় সাম্রাজ্যবাসী দেশগুলি আফ্রিকার মতো অনুন্নত দেশগুলিকে লুটেরার মত লুঠ করেছিল কয়েক শতাব্দী ধরে । সেই নির্গম ইতিহাস ধরা আছে ‘আফ্রিকা’ কবিতাতে ।
- পঞ্চমত: বর্ণগত – বিত্তগত এবং বর্গগত -তিনটি বিভাজন ধরা পড়েছে ‘আফ্রিকা ‘ কবিতাতে ।
কবিতার ব্যাখ্যা:
‘আফ্রিকা’ কবিতায় চারটি স্তবক আছে ।
প্রথম স্তবক: প্রথম স্তবকে ১৯ টি লাইন বা চরণ আছে ।
কবিতার প্রথম স্তবকে দার্শনিক রবীন্দ্রনাথের পরিচয় পাই এবং পাশাপাশি আফ্রিকা সৃষ্টি প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ ভূগোলের তত্ত্বকে উপস্থাপিত করেছেন । আফ্রিকা মহাদেশ সৃষ্টির ভৌগোলিক তত্ত্বকে তুলে ধরেছেন ।
বিশ্বসংসারের সৃষ্টি করা অর্থাৎ পরমেশ্বর নিজের সৃষ্টি কে নিয়ে সন্তুষ্ট ছিলেন না । ঈশ্বর হলেন পরমশিল্পী । তাঁর সৃষ্টিকে নিয়ে তিনি কিছুতেই তৃপ্ত হতে পারছিলেন না । এইরকম ভাঙ্গব গড়ার মধ্যে দিয়ে জন্ম হয়েছিল আফ্রিকা মহাদেশের ।
ঘন ঘন মাথা নাড়া কথাটির মধ্যে দিয়ে স্রষ্টার অসন্তোষ, অতৃপ্তিকে বোঝাতে চেয়েছেন । তিনি জগৎ সৃষ্টি করার পর তার মনে হল কাজটি মনের মতো হয়নি । যেরকম ভাবে তিনি তাঁর সৃষ্টিকে রুপসীতে চেয়েছেন, তেমনটি হয়নি । স্রষ্টার যে নিজস্ব যন্ত্রনা থাকে, সেই যন্ত্রনা ঈশ্বরকেও অধৈর্য, অসন্তুষ্ট করে তুলেছে ।
রবীন্দ্রনাথ স্থুলার একটি শব্দ ব্যবহার করেছেন ‘প্রাচী’ । এখানে ‘আফ্রিকা’ সৃষ্টির ভৌগোলিক তত্ত্বকে ব্যাখ্যা করা হয়েছে । জার্মান বিজ্ঞানী আলফ্রেড ওয়েগনারের ১৯১৪ সালের মহাদেশীয় চলন তত্ত্বের কথা বলেছেন । বা পাত সংস্থানিক যে তত্ত্ব তার কথা বলেছেন ।
কার্বোনিকেরাস যুগে সম্মত মহাদেশ একসাথে ছিল এবং অতিকায় মহাদেশ নাম ছিল প্যাঞ্জিয়া ।প্যাঞ্জিয়াকে ঘিরে ছিল বিশাল মহাসাগর , যাকে বলা হয় প্যানথালাসা । আমেরিকা, ইউরোপে ও এশিয়া নিয়ে গঠিত ছিল প্যাঞ্জিয়ার উত্তরাংশ – যার নাম ছিল লরেমিয়া । প্যাঞ্জিয়ার দক্ষিণ অংশ গঠিত ছিল দক্ষিণ আমেরিকা । আফ্রিকা, ভারতবর্ষ, অস্ট্রেলিয়া এবং আন্টার্টিকা নিয়ে । যার নাম ছিল গন্ডোয়ানা ল্যান্ড। টেথিস নামক এক অগভীর সাগর দ্বারা এটি পৃথক হয়ে যায় । প্যাঞ্জিয়ার কিছু অংশ পশ্চিমদিকে অগ্রসর হয় এবং কিছু অংশ পূর্বদিকে অগ্রসর হয় । আফ্রিকাপাত ধীরে ধীরে আলাদা হয়ে যায় । সেই ভৌগোলিক ব্যাখ্যা রবীন্দ্রনাথ এখানে বলতে চেয়েছেন ।
বড়ো গাছ বা বৃক্ষকে বনস্পতি বলা হয় । আফ্রিকা তার সৃষ্টি থেকেই বড় বড় গাছের অরণ্যে ঘেরা ছায়াচ্ছন্ন একটি মহাদেশ । ঘোমটা ঢাকা নারীর মতোই ছায়াবৃতা ছিল আফ্রিকা । আফ্রিকাকে অর্থাৎ আফ্রিকার মানুষদেরকে পাহারা দিচ্ছিল বনস্পতির নিবিড় অরণ্য ।প্রকৃতির পাহারায় আদিম আফ্রিকা নিরাপদে নিশ্চিন্তে ছিল । তাই বনস্পতির নিবিড় পাহারা বলতে কবি আফ্রিকার প্রাকৃতিক সম্পদ ও সৌন্দর্যকে বোঝাতে চেয়েছেন ।
সেখানে নিভৃত অবকাশে—–দুর্গমের রহস্য___ আলোছায়াময় রহস্যপূর্ণ পরিবেশ আফ্রিকাবাসীর শুরু হয়েছিল আত্মপ্রতিষ্টার সংগ্রাম ।
সদ্যোজাত শিল্প যেমন সময়ের সঙ্গে সঙ্গে চারপাশকে চিনে নিতে শুরু করে, তেমনি আফ্রিকাবাসী দুর্নমের রহস্য সংগ্রহ করে জল-স্থল আকাশের দুর্বোধ্য সংকেতকে বুঝে নিতে চাইছিল ।
“প্রকৃতির দৃষ্টি অতীত জাদু—–তোমার চেতনাতীত মনে ।”
আফ্রিকা প্রকৃতির কোলে লালিত হচ্ছিলো । একদিকে নিবিড় বনাঞ্চল, অন্যদিকে সাহারা, কালাহারির মতো মরুভুমি, যেন আফ্রিকাকে লালন করছে ।ভয়ংকর বন্যজন্তু আর দুর্গম প্রকৃতি যেন সেই সৃস্টিপর্বে আফ্রিকাকে গড়ে তুলেছিল ।সদ্য গড়ে ওঠা এই মহাদেশ কবির ভাষায় চেতনাতীত অর্থাৎ তার নির্যস্স সংহতি বা জীবনধারা তখন ও গড়ে ওঠেনি ।অর্থাৎ সভ্য দেশগুলির মতো চেতনার বিকাশ হয়নি আফ্রিকাবাসীর ।
“বিদ্রুপ করেছিল……….তান্ডবের দুন্দুভি নিনাদে ।”
সভ্যতার সৃষ্টির প্রথমপর্বে আফ্রিকা বাইরের পৃথিবীর কাছে পরিচিত ছিল ভয়ংকর, দুর্গম-একটি জায়গা হিসেবে । অর্থাৎ এখানে ভয়ংকর জীবজন্তু থাকে, দুর্গম জায়গা, সভ্য মানুষ সেখানে থাকতে পারে না, আর এজন্যই আফ্রিকার প্রতিকূল প্রাকৃতিক পরিবেশ আফ্রিকাকে রক্ষা করেছিল বহিঃশত্রুর হাত থেকে ।বিরূপের ছদ্মবেশে অর্থাৎ শ্রীহীন, কুরুপ দিয়ে যেন আফ্রিকা পৃথিবীর অন্যান্য শত্রুদের হাত থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে রেখেছিল ।নিজের অস্তিত্বকে, নিজের ভয়কে সে জয় করেছিল বিভীষিকা অর্থাৎ ভয়ংকর কে আশ্রয় করে ।
দ্বিতীয় স্তবক:
‘হায় ছায়াবৃতা’-কবি আফ্রিকা মহাদেশকে ছায়াবৃতা বলেছেন । অর্থাৎ ছায়ায় ঢাকা (স্ত্রীলিঙ্গে-আবৃতা ) । আফ্রিকায় বড়ো বড়ো গাছপালার ঘন জঙ্গল ভেদ করে যেখানে সূর্যের আলো প্রবেশ করতে পারে না । তাই সে ছায়ায় ঢাকা ।
আবার অন্য অর্থে-সভ্য জগতের আলো বা সভ্যতার আলো তখনো আফ্রিকার আদিবাসী সমাজে তখনো প্রবেশ করেনি । তারা সভ্য সমাজের চোখে বর্বর উপেক্ষিত ।তাই আফ্রিকাকে ছায়াবৃতা বলা হয়েছে ।
আর তখনই পাশ্চাত্য সাম্রাজ্যবাসী দুনিয়া আফ্রিকাকে দেখছে-
- উপেক্ষার দৃষ্টিতে
- আবিল দৃষ্টিতে
- এবং অবমাননার দৃষ্টি
অর্থাৎ আফ্রিকাকে এরা সঠিকভাবে বিচার করছে না ।আসলে আফ্রিকাতে তখন পাশ্চাত্য জ্ঞানের আলো প্রবেশ করেনি ।আফ্রিকার এই ঐতিহ্য, প্রাচীন, সংস্থটিকে, Tribe Culture কে উপেক্ষা করেছিল সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলো ।
আফ্রিকার প্রাকৃতিক সম্পদের লোভে পাশ্চাত্য শক্তি এলো লোহার হাতকড়ি নিয়ে । আফ্রিকার কালোমানুষকে তারা দাসে পরিণত করল ।এইভাবে আফ্রিকায় লুন্ঠন করা হল তার ধাতু সম্পদ ও মানব সম্পদকে ।
রবীন্দ্রনাথ এই পৈশাচিক হত্যালীলা কে সমর্থন করেননি ।তিনি বললেন পাশ্চাত্য সভ্যতা নাগিনী স্বরূপ ।নখ যাদের তীক্ষ্ণ, নেকড়ের চেয়ে ।
সভ্যের বর্বররূপ: বিদ্যাসাগর আখ্যানমঞ্জুরিতে সভ্য ও অসভ্য গল্প লিখেছেন । তিনি সেখানে সেখিয়েছেন প্রকৃত সভ্য করা ।রবীন্দ্রনাথ ও বঙ্গ করে বললেন– সভ্যের বর্বররূপ অর্থাৎ অসভ্য । পাশ্চাত্য সাম্রাজ্যবাদী শক্তির ছিল অমানুষতা অর্থাৎ মনুষ্যত্বের অধিকার থেকে তারা বঞ্চিত ।
ফ্রান্স, বেলজিয়াম, ব্রিটেন, জার্মানি, ইটালি-ইউরোপের প্রায় প্রতিটি দেশই আফ্রিকায় ঔপনিবেশ স্থাপন করে এবং গোটা আফ্রিকা ইউরোপের উপনিবেশে পরিণত হয় । আফ্রিকাকে লুন্ঠন করে সেখানকার আদিম জনজাতিদের শোষণের যে ইতিহাস রচিত হয়, এখানে সেই কথাই বলা হয়েছে ।
“দস্যু পায়ের কাঁটা মারা জুতোর তলায়-নিষ্পেষিত হল একটি মহাদেশের ভালোবাসার ইতিহাস।কবি তাই বলেছেন মহাদেশের চিরচিহ্ন দিয়ে গেল তোমার অপমানিত ইতিহাস ।”
জার্মান চিত্রকর PAULKLEE যেমন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ভয়ংকর পরিণতি ক্যানভাসে তুলে ধরে ছিলেন, ঠিক তেমনি ভাবে রবীন্দ্রনাথ অসাধারণ শব্দ চয়ন করে শব্দ দিয়ে দিয়ে শব্দের ছবি আঁকলেন ।প্রকাশ করলেন সাম্রাজ্যবাসী শক্তির নগ্নরূপকে ।
এবার আসি কবিতার তৃতীয়ত স্তবকে
“সমুদ্রপারে সেই মুহূর্তেই তাদের পাড়ায় পাড়ায়-”
তাদের পাড়ায় বলতে ইউরোপ দুনিয়ায় ।অর্থাৎ ইউরোপ সভ্যতার মানদণ্ড আলাদা ও স্বতন্ত্র হয়ে উঠেছে অথচ অন্যের জায়গায় দাঁড়িয়ে অন্যকে তারা নিষ্পেষিত করে চলেছে ।সাম্রাজ্যবাসী ইউরোপের শোষণ-দমন-পীড়নে যখন আফ্রিকার মানুষ বিপন্ন তখন ইউরোপে বিরাজ করছে শান্তির বাতাবরণ ।
আফ্রিকার মুন্সির গুলো অন্ধকারাচ্ছন্ন অথচ ইউরোপের মনিসরে পূজার ঘন্টা বাজছে, সেখানে উৎসবের আমেজ ।
সেখানে শিশুরা খেলছিল মায়ের কোলে অথচ আফ্রিকায় শিশুরা মায়ের কোল থেকে চ্যুত হয়ে মৃত্যুর সম্মুখীন হয়েছিল ।
সভ্য ইউরোপবাসী আফ্রিকার উপর বর্বর এর মত ব্যবহার করছে অথচ নিজের দেশে শান্তির বীজ বপন করছিল ।
ইউরোপের কবিরা মুন্সরের আরাধনা করছেন, তারা কেউই এই পাশবিক শক্তির প্রতিবাদ করছেন না ।অথচ প্রতিবাদ করছেন রবীন্দ্রনাথ ।
তোমরা যদি রবীন্দ্রনাথের গোরা উপন্যাস পড়ো তাহলে সেখানে দেখবে-গোরা কিভাবে সংকীর্ণ মানসিকতা থেকে বেরিয়ে জাতীয় ভাবধারায় উদ্বুদ্ধ হচ্ছে, তাই রবীন্দ্রনাথ স্থান-কালের মধ্যে সীমাবদ্ধ নন, তিনি আন্তর্জাতিক কবি–তাই তো প্রতিবাদ করতে পারেন সাম্রাজ্যবাসী শক্তির নগ্নরূপের বিরুদ্ধে ।
কবিতার শেষ স্তবক অর্থাৎ চতুর্থ স্তবক
‘আজ যখন পশ্চিম দিগন্তে’-পশ্চিম শব্দটির ব্যাঞ্জনা আছে ।কবি শঙ্খ ঘোষ বাবরের প্রার্থনা কবিতায় পশ্চিমে ফায়ার আল্লাসহর উপাসনার কথা বলেছেন ।ঠিক তেমনি বিবেকানন্দ প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য গ্রন্থে পশ্চিম অর্থে পাশ্চাত্য শব্দটি ব্যবহার করছেন ।
রবীন্দ্রনাথের ও প্রিয় শব্দ পশ্চিম ।পশ্চিম দিগন্তে সূর্যাস্ত হয় আর সন্ধ্যা নেমে আসে । সন্ধ্যা নিয়ে আসে অন্ধকারকে ।তার উপর ঝড়বাদল হলে পরিবেশ বিপর্যস্ত হয় ।এই সময় গোপন গহ্বর থেকে বেরিয়ে আসে হিংস্র পশুরা ।এমনই বিপর্যয় আফ্রিকার বুকে নামিয়ে এসেছিল সাম্রাজ্যবাসী ইউরোপীয় রাষ্ট্রশক্তি । তাই পশ্চিম দিগন্ত বলতে কবি স্থেরাচারী পশ্চিমি দেশগুলির নগ্ন রুপকে তুলে ধরেছেন ।
‘অশুভ ধ্বনি’ বলতে মানবতার অপমানকে বোঝানো হয়েছে ।পাশ্চাত্য দুনিয়ায় আছে জ্ঞানের আলো, যা শুধু নিজের ঘর গুছিয়ে অথচ অণ্যের ঘরে আগুন লাগিয়েছে ।পাশ্চাত্য দেশে যেন কালবৈশাখী ঝড় উঠেছে অর্থাৎ পাশ্চাত্য দুনিয়ার মধ্যে অসম লড়াই-আমাদের অধিকারে আমরা কতটা পাবো ।
রবীন্দ্রনাথ পাশ্চাত্য সাম্রাজ্যবাসী শক্তিগুলিকে হিংস্র পশুর সঙ্গে তুলনা করেছেন। প্রত্যেক মানুষের মধ্যে দুটো রূপ থাকে-Biological Needs এবং Spiritual Needs ।ইউরোপের দুনিয়া যেন Biological Needs অর্থাৎ পশুত্ব লাভ করেছিল ।
এসো যুগান্তের কবি : ইউরোপের সাম্রাজ্যবাসী শক্তিগুলির মধ্যে অসম লড়াই ও অস্থিরতা, অন্যদিকে আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে স্বাধীনতার জন্য লড়াই-এই দুই মিলে আফ্রিকায় এক পালাবদলের সম্ভাবনা কবির কাছে স্পষ্ট হয়েছিল ।আফ্রিকাতে সাম্রাজ্যবাদের যে কার্য দমন – পীড়ন আর মানবতার লাঞ্ছনা চলছে সেই কলঙ্কিত যুগের অবসান ঘটিয়ে নতুন যুগের শুভারম্ভ হার যুগান্তের কবির হাতে ।
অন্ধকারের উৎস থেকে মনুষ্যত্ব এবং শুভবোধের আলো উৎসারিত করেন যিনি তিনিই যুগান্তরের কবি ।
রবীন্দ্রনাথ যুগান্তের নবীন কবিকে আহ্বান করেছেন ‘মানহারা মানবী’ আফ্রিকার কাছে ক্ষমাপ্রার্থনার জন্য ।অপমানের ইতিহাসকে মনে রেখে নতি স্বীকার করে প্রায়শ্চিত্ত করতে বলেছেন ।
পাশ্চাত্য দুনিয়ায় অন্তিমকাল ঘনিয়ে এসেছে ।যুগান্তরের কবিরা প্রতিবাদ করুক । আফ্রিকাবাসীর পাশে দাঁড়িয়ে এই বার্তা দাও-ক্ষমা করো ।অর্থাৎ পারস্পরিক হিংসা নয়, দেশ নয়, নিঃশর্ত ক্ষমা চাইবার কথা বলা হয়েছে ।
বোধের আলো উৎসারিত করেন যিনি তিনিই যুগান্তরের কবি ।
রবীন্দ্রনাথ যুগান্তের নবীন কবিকে আহ্বান করেছেন ‘মানহারা মানবী’ আফ্রিকার কাছে ক্ষমাপ্রার্থনার জন্য ।অপমানের ইতিহাসকে মনে রেখে নতি স্বীকার করে প্রায়শ্চিত্ত করতে বলেছেন ।
পাশ্চাত্য দুনিয়ায় অন্তিমকাল ঘনিয়ে এসেছে ।যুগান্তরের কবিরা প্রতিবাদ করুক । আফ্রিকাবাসীর পাশে দাঁড়িয়ে এই বার্তা দাও-ক্ষমা করো ।অর্থাৎ পারস্পরিক হিংসা নয়, দেশ নয়, নিঃশর্ত ক্ষমা চাইবার কথা বলা হয়েছে ।
Sir ,
Audio ar babasta nii
[email protected]
Hi bro